বাংলার সকাল ডেস্ক : হজ শব্দের আভিধানিক অর্থ ‘ইচ্ছা’ বা ‘সংকল্প’। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় কাবা শরিফ জিয়ারত করার উদ্দেশ্যে ভ্রমণের ইচ্ছা বা সংকল্প করা। এটি মুসলমানদের জন্য একটি আবশ্যকীয় ইবাদত। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সক্ষম প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর জন্য জীবনে একবার হজ সম্পাদন করা ফরজ বা আবশ্যিক। আরবি জিলহজ মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখ হজের জন্য নির্ধারিত সময়। হজ পালনের জন্য বর্তমান সৌদি আরবের মক্কা নগরীতে কাবা শরিফের তওয়াফ এবং মিনা, আরাফাত, মুজদালিফা, পশু কুরবানি, কঙ্কর নিক্ষেপ, সাফা-মারওয়া টিলাদ্বয়ের মধ্যে হাঁটা জরুরি। হজ মুসলিম উম্মাহর সর্ববৃহৎ মিলন উৎসব।
হজের কেন্দ্রস্থল
হজের মূল কেন্দ্রবিন্দু হলো পবিত্র কাবাঘর। যা মক্কা নগরীতে অবস্থিত। মক্কায় পৌঁছে এটি ঘিরে সাতবার প্রদক্ষিণ করতে হয়, যাকে তওয়াফ বলা হয়। হজের শেষেও এখানে তওয়াফ করতে হয়। এই কাবাঘর সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন মাজিদে বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে প্রথম ঘর যা মানুষের জন্য স্থাপন করা হয়েছিল, তা তো মক্কায়, যা বরকতময় এবং সারা জাহানের জন্য পথপ্রদর্শক’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৬)। পবিত্র কাবাঘর কখন নির্মিত হয়েছিল এ নিয়ে বিভিন্ন বর্ণনা এসেছে। সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য মত অনুযায়ী, মহান আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে ফেরেশতারাই সর্বপ্রথম কাবাঘরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। হজরত আদম আলাইহিস সালাম ও হজরত হাওয়া আলাইহিস সালামের পৃথিবীতে মিলন হলে তারা উভয়ে আল্লাহ তায়ালার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ইবাদতের জন্য একটি মসজিদ হজরত আদম আলাইহিস সালাম আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাঁদের দোয়া কবুল করেন এবং বায়তুল মামুরের আকৃতিতে ঠিক তার নিচে পৃথিবীতে পবিত্র কাবাঘর স্থাপন করেন।
ইবরাহিম (আ.)-এর যুগে হজ
আদম (আ.)-এর যুগে কাবা নির্মিত হলেও নুহ (আ.)-এর যুগে হওয়া মহাপ্লাবনে তা ভেঙে যায়। ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.) তা একই স্থানে পুনর্নির্মাণ করেন। এরপর আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিম (আ.)-কে জিবরাইল (আ.)-এর মাধ্যমে হজের পদ্ধতি শিখিয়ে দেন। তারপর তাঁরা সে অনুযায়ী হজ পালন করেন। একদিন ইবরাহিম (আ.) স্বপ্নের মাধ্যমে তাঁর প্রিয় পুত্রকে জবাই করার জন্য আদিষ্ট হন। ইসমাইল (আ.) তাতে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। পরে তাঁকে জবাই করার চেষ্টা করা হলে আল্লাহ তায়ালা তাঁর কুরবানি কবুল করে নেন। এ ব্যাপারে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে এভাবে- ‘তিনি যখন তাঁর পিতার সঙ্গে চলাফেরা করার বয়সে পৌঁছালেন, তখন ইবরাহিম (আ.) বললেন, হে বৎস! আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, আমি তোমাকে জবাই করছি, এখন বলো, তোমার অভিমত কী? তিনি বললেন, ‘হে পিতা! আপনাকে যা আদেশ করা হয়েছে আপনি তাই করুন, আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্যশীলই পাবেন’ (সুরা সাফফাত ১০২)। কুরবানির স্থলে যাওয়ার সময় শয়তান যখন ইসমাইল (আ.)-কে প্ররোচনা করার চেষ্টা করে তখন তিনি শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ করেন। তিন জায়গায় এই পাথর নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এর আগে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে যখন ইবরাহিম (আ.) তাঁর স্ত্রী হাজেরা ও শিশুপুত্র ইসমাইলকে মক্কায় রেখে যান তখন সেখানে কোনো মানুষ, গাছপালা ও খাবার পানি ছিল না। হাজেরা তখন পানির খোঁজে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে দৌড় দিয়েছিলেন। আল্লাহ তায়ালা হাজেরা, ইবরাহিম ও ইসমাইল (আ.)-এর এই চেষ্টা ও কুরবানিকে এতই কবুল করেছেন যে, তাঁদের প্রতিটি কাজ হজের কার্যাবলির অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন।
ইসলাম-পূর্ব যুগে হজ
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মের আগেও আরবরা হজ পালন করত। ইবরাহিম (আ.)-এর যুগ থেকেই এই হজের প্রচলন চলে আসে। এ জন্য আরবরা হজের মাসগুলোতে তথা শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ এবং হজ-পরবর্তী শাওয়াল মাসে যুদ্ধবিগ্রহ করত না। কাবাঘরকে কেন্দ্র করে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসত এবং হজের বিভিন্ন রীতি পালন করত, যা ইবরাহিম আলাইহিস সালামের দেখানো হজ থেকে ভিন্ন ও বিকৃত ছিল। তারা সাফা-মারওয়া পাহাড়ে এবং কাবাঘরে মূর্তি রেখে পূজা করত। উলঙ্গ হয়ে কাবাঘর তওয়াফ করত।
নবীজির যুগে হজ
বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী আল্লাহ তায়ালা এই উম্মতি মুহাম্মদির ওপর নবম হিজরিতে হজ ফরজ করেন। তিনি বলেন, ‘ওই ঘর পর্যন্ত যার পৌঁছার সামর্থ্য আছে আল্লাহর জন্য তার ওপর হজ করা আবশ্যক’ (সুরা আলে ইমরান : ৯৭)। এ আয়াতের ভিত্তিতে হজ ফরজ হয়। এ আয়াত নাজিলের পর রাসুলুল্লাহ (সা.) আবু বকর (রা.)-কে আমির নিযুক্ত করে হজ পালন করার জন্য পাঠান। সেবার ৩০০ সাহাবি হজ পালন করেছিলেন। এই হজের সময় সুরা তওবা অবতীর্ণ হয়।
ওই সুরায় মুশরিকদের সঙ্গে থাকা শান্তিচুক্তি তারা ভঙ্গ করতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক করেন এবং নির্দেশ দেন আজকের পর থেকে মুশরিকরা হারাম শরিফের সীমানায় প্রবেশ করতে পারবে না এবং কেউ যেন হারাম মাসগুলোতে যুদ্ধের আশঙ্কা না করে। তাই রাসুল (সা.) হজরত আলি (রা.)-কে ডাকলেন এবং বললেন, সুরা তওবায় হজ বিষয়ে যে বিধান ঘোষণা করা হয়েছে, তা মুসলিমদের জানিয়ে দাও। তখন আলি (রা.) মিনায় সমবেত মুসলিমদের মধ্যে মুশরিকদের ব্যাপারে পবিত্র কুরআনের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দেন।
নবীজির নির্দেশে সেদিন তিনি যে ভাষণ দিয়েছিলেন, তাতে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনো কাফের জান্নাতে প্রবেশ করবে না। আজকের পর কোনো মুশরিক হজ করতে পারবে না এবং বায়তুল্লাহর তওয়াফ করতে পারবে না। মুশরিকদের সঙ্গে মুসলিমদের শান্তিচুক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত বহাল ছিল যতক্ষণ তারা তা ভঙ্গ করেনি।’ এরপর দশম হিজরিতে রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে হজ পালন করেন। তখন লক্ষাধিক সাহাবি হজে অংশগ্রহণ করেছিলেন বলে মত পাওয়া যায়। এটিই ছিল রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পালনকৃত একমাত্র হজ। হজ থেকে ফিরে তিনি ইন্তেকাল করেন। এ হজে আরাফাতের ময়দানে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন তাকে বলা হয় বিদায় হজের ভাষণ।